বিজয় পেয়েছি ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে৷ আজ ২৬শে মার্চ ২০১২ অর্থাত্ স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্ণতা পেয়েছে৷ এই ৪০, অনেকটা গুরুত্ব বহন করে৷ মুসলিম হিসাবে মনে-প্রাণে, চিন্তা-চেতনায় সবসময় ৪০কে আলাদা ও বিরাট গুরুত্ব দিতে চাই৷ আমরা জানি সম্মানিত হাজ্বীগণ হজ্ব শেষে মসজিদে নববীতে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায আদায় করেন৷ চল্লিশ দিনের এক চিল্লায় আল্লাহর রাস্তায় মানুষকে আহবান জানানো ৷ শুধু তাই নয়, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ( সা: ) এর জীবনে নবুয়াতপ্রাপ্তি ঘটে ঠিক ৪০ বছর বয়সেই৷ না আগে আর না পরে৷ নাযিল হয় আল্লাহর বিধান মহান গ্রন্থ কোরআন শরীফ৷
আজ তাই জাতির জনক কর্তৃক ঘোষিত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে চল্লিশ উর্দ্ধ বয়সে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে কিছু প্রশ্ন এবং তার উত্তর জানতে চাই৷ কেন ৭ই মার্চ স্বাধীনতা দিবস হলো না! হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বীর বাঙ্গালীকে ৭ই মার্চ এর ভাষণে বাংলার মাটিকে স্বাধীন করবার আহবান জানানো হয়েছিল, কেন এই ৭ই মার্চকেই স্বাধীনতা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হলো না, আমি বুঝিনা৷ বুঝতে চাই৷ কেন ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে "জয় বাংলা" স্লোগান দিয়ে শত শত রাজাকার ও সুবিধাভোগীরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেল আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ঘর-হারা, মা-বাবা, সংসার হারা হলো? বাড়িঘর লুটতরাজ, আগুনে পুড়ে সর্বশ্রান্ত হয়ে দিশেহারা দুঃস্থ্য বনে গেল? যেন তাদের দেখার, লালন-পালন করবার কেহ নেই! তাদের দুঃখে সাথী হবার কেউ নেই! নিদারুন সেই যন্ত্রনায় কাতর বীরেরা সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়, যখন বর্বরদের মত হাতিয়ার জমা দেয়৷ তারা একদিকে বিজিত অন্যদিকে পরাজিত৷ তাদের সাথে ঘটা ঘটনা বা রটনাকে মর্মান্তিক বলা ছাড়া উপায় নেই৷ অবশ্য অন্যদিকে পরাজিতদের পোয়া বার! তাদের ভালো মন্দ খাবারের সুব্যবস্থা এবং সৌদি সরকার প্রায় ৯৩ হাজার পরাজিত সৈন্যদের তাদের দেশে পুর্নবাসিত করলেন৷ ভালো বেতন, বাসা-বাড়ি সব৷ আর যারা ইতিহাস গড়লো! তারা কি পেল? যুদ্ধে যাওয়ায় পরিবার ধ্বংস, বসত বাড়ি ধ্বংস! যেদিকে তাকায় শুধু ধ্বংসের স্তুপ৷ তাদের আগলাবার কেউ নেই৷ যেইনা হাতিয়ার জমা নেয়া হলো ওমনি সেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ১০/২০ টাকা দামের সনদপত্রের মালিক বনে ঘৃণায়, লজ্জায় বিপর্যস্ত হয়ে হতবাক৷ তারা মূল্যহীন আর্বজনায় পরিনত হলো হাতে গোনা গুটি কয়েক সুবিধাভোগী ছাড়া৷
৪০ বছর পর উত্তর খুঁজে বেড়াই, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যে প্রশাসন বর্বদের নির্দেশ মেনে প্রতিযোগিতাতে নেমেছিল, আবার তারাই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রশাসনে থাকে কি করে? মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নিয়ে বীরদর্পে প্রশাসনে বসে গেলেন! চালানো শুরু করল তাদের প্রকৃত পিতাদের নির্দেশে অতি গোপনে, সন্তপর্ণে ষড়যন্ত্র৷ ষড়যন্ত্রে দিশেহারা করে দিলেন বঙ্গবন্ধুকে৷ সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতা পাবার পর সেখানে পরাহিতদের দেশের প্রশাসনে বসানোটাকে কত বড় ভুল হয়েছিল না কী হয়েছিল তা কি এখনো মূল্যায়নের সময় আসে নাই? এর উত্তর জানতে চাই৷ লুটতরাজ কারা করেছিল? দেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ কিভাবে হয়েছে? মজলুম জননেতা ভাসানী হুজুর, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, সেক্টর কমান্ডার আব্দুল জলিল, কর্ণেল তাহের, ইসতেহার পাঠক শাহজাহান সিরাজ, আ.স.ম. আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খান, কমরেড মনিসিংহ, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকার এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তারা কোথায় ছিটকে পরলেন? এগুলো কি সেই রাও্ফরমান আলীর প্রশাসনের চামচাদের নিরবে, গোপনে বিষাক্ত ছোবলের কারসাজি ছাড়া অন্য কিছু? জানতে চাই, জানার খুব ইচ্ছে৷
এজন্যেই কি স্বাধীনতা বিরোধী চক্র শাহ আজিজ, আব্দুর আলিম, আব্দুর রহমান, নিজামী, মুজাহিদ এদের গাড়িতে রক্ত লাল সবুজ পতাকা উড়ে! একারণেই কি দেলোয়ার হোসেন শিকদার, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, রাজাকার বলে গর্ববোধ করে ও পবিত্র পার্লামেন্টে সম্মানিত সদস্য পদ লাভ করে! এর সমাপ্তি কি ৪০ এর পরে আমরা দেখতে পাবো? জাতি জানতে চায়, আমি দেখতে চাই৷
যুদ্ধ বিধ্বস্ত, সর্বক্ষেত্রে ধ্বংসের স্তুপ থেকে দেশকে গড়ার জন্য দেশ থেকে দেশান্তরে দিন ও রাতের ঘুম হারাম করে জাতির জনক যখন দেশকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে বিভোর, তখন টিক্কা / রাওফরমান আলীর প্রশাসনের চামচারা দেশকে অকার্যকর ও ব্যর্থতার চরমে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রে পূর্ণ কার্যকর ভূমিকা পালন করছিল অত্যন্ত সন্তপর্ণে, নিরবে নিভৃতে৷
জাতির প্রকৃত শ্রেষ্ঠ সন্তানরা যে ছাত্র সে শিক্ষালয়ে, যে শ্রমিক সে কারখানায়, যে কৃষক সে ক্ষেত খামারে, যে পুলিশ সে পুলিশ বাহিনীতে, যে আর্মি সে আর্মিতে আর গুটিকয়েক সুবিধাভোগী রক্ষিবাহিনীতে আশ্রয় নিয়েছিল৷ যুদ্ধকালীন সময়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মৃত্যুকে জয় করে রক্তের বাঁধনে বাঁধা ভাই হিসাবে যারা স্বাধীনতা এনে বাংগালীকে সারা বিশ্বে বীর জাতি হিসাবে পরিচিত করলো, তাদেরকে চক্রান্তকারীরা বিভক্ত করে একে অপরের রক্তে রঞ্জিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে অতি চাতুরতার সাথে দেশকে ক্ষত-বিক্ষত করে, জাতির জনককে সপরিবারে শহীদ করে দেশকে নেতা শুন্য করে দিল৷ উন্নয়নের যাত্রাকে স্তদ্ধ করে দেশ ও জাতিকে করলো কলংকিত৷ থেমে রইল না ওদের ষড়যন্ত্র৷ ওদের সুকৌশলে ফাসিকাষ্ঠের প্রায় ৭০০ আসামীসহ, ১১৫০০ জন যুদ্ধাপরাধী ছাড়া পেয়ে গেল জেল থেকে৷ জাতি যেন ঘুরে দাঁড়াতে না পারে তার জন্য ৪ নেতাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান জেলখানা, সেখানেই তাদেরকে নির্মমভাবে শহীদ করা হলো৷ একি! এইকি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ! আজ চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করে মীরজাফর, ইয়ারলতিফ, জগত্শেঠ, উমিচাঁদ ঐসব বেঈমানদের যে, হায়রে! তোমাদের মহামতি স্টালিনের মত করে যদি বাংলার পবিত্র মাটি থেকে উচ্ছেদ করে দিতে পারতাম, যাতে করে তোমাদের রক্তও যেন দেশের মাটিতে না পরতো!
রাশিয়া, চিন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, মালয়শিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ওরাতো ভালই আছে৷ আমরাও জাতির এই কলংক মুছে ভালো হতে চাই৷ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই৷
"যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার"৷
হে তরুন প্রজন্ম, তোমরাই পারবে জাতিকে কলংকমুক্ত করতে, জাতি হিসাবে দেশকে বিশ্ব সভায় সম্মানিত করতে, লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে অর্থবহুল করতে৷ জাতি হিসাবে আমরা বীর, কাজেই কোন রক্ত চক্ষুকে ভয় পাবার কিছু নাই৷ কে আছো বীর, ধনুকে লাগাও তীর৷ ছি্ন্ন ভিন্ন করে দাও যত সব ষড়যন্ত্র এই হোক ৪০ বছরের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র৷
সকল জঞ্জাল ও কলংক ধুয়ে মুছে পুত ও পবিত্র হোক এই দেশ৷ জাতি হোক গর্বিত৷
স্বাধীনতা
স্বাধীনতা! তুমি আসো এক বত্সর পরে পরে,
তুমি লুকোচুরি খেল মোদের মনে৷
কত হাসি, গান, আনন্দ, উল্লাস
ভরিয়ে দাও আমাদের মনে৷
আবার তুমি পালিয়ে যাও রাতের অন্ধকারে,
কোন সে দূর বনে?
আমরা তখন হাহাকার হৃদয় নিয়ে,
বসে থাকি তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে৷
স্বাধীনতা! সত্যিই তুমি মনোরম, মধুময়,
আবার তুমি আসবে বলে কত আনন্দের ঢেউ
খেলতে থাকে আমাদের মনে,
তাই সারাটি বত্সর আমরা তোমাকে
স্মরণ করি ক্ষনে ক্ষনে৷
স্বাধীনতা, তোমাকে স্বাগতম জানাই
আবারো তুমি আসবে আমাদের সামনে৷
(কবি- ফাতেমা আক্তার৷ গৃহিনী, বর্তমানে টাংগাইলে নিজবাসস্থানে বসবাস করছেন৷ স্বামী মরহুম ডা: ইদ্রিস আলী৷ ১৯৭১ সালে লিবিয়াতে থাকাকালীন স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে হঠাত্ করেই লেখা৷ তত্কালীন লিবিয়াতে বাঙ্গালী কমিউনিটির একটি ম্যাগাজিনে কবিতাটি প্রকাশিত হয়৷)