সোমবার, এপ্রিল ৩০, ২০১২

ইস্পাত....How the Steel was Tempered....


এই ভরদুপুরে লোডশেডিং এর অত্যাচারে অতিষ্ট। ঠান্ডা পানি গলায় ঢালার তীব্র ইচ্ছে অবদমিত হচ্ছে...মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটায়। ভাবছি, ইচ্ছে করলেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি দুপুরটা। কিন্তু আজকাল মনে হয় যতটুকু সময় জীবনের আছে...সেন্স নিয়ে বাতাসগুলো শুষে নিয়ে সময়ের কাছ থেকে নিগ্রে নিতে থাকি না কেন...যখন যা পাই!!
পা ঘোরালাম লাইব্রেরীর দিকে, হাত বাড়াচ্ছি ডিটেকটিভ টাইপের একটা বইয়ের দিকে কিন্তু নজর চলে গেল..."ইস্পাত" এর দিকে। "ইস্পাত"...সাহিত্যের বাস্তব ঘরানার সবচেয়ে শিক্ষনীয়, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচাইতে মর্মস্পর্শী একটি সাহিত্য যার স্রষ্ঠা "নিকোলাই অস্ত্রভস্কি", "Nikolai Ostrovsky" (জন্ম ১৯০৪- মৃত্যু ১৯৩৬)। আমার বাস্তব ঘরানোর সাহিত্য শিক্ষার প্রথম ধাপগুলোর মধ্যে, এই অমর সৃষ্টি একটি। বইটি হাতে নিয়ে নতুন করে পাতা উল্টাতে খুব মন চাইলো।
নিকোলাই অস্ত্রভস্কি এমন এক অমর জীবনসাহিত্যিক যার জীবনকাল ছিল মাত্র ৩২ বছর। এই স্বল্পকালীন জীবনাবস্থায় জীবন থেকে কতটুকু শেখা যায় সেটা তো পরিস্কার! কিন্ত কতটা অবর্ণনীয় কষ্টকর জীবন অধ্যায় ছিল, তা তিনি একেঁ গিয়েছেন তার জীবনবাদী সাহিত্য "ইস্পাত" এ।
তার জীবনের যে চিত্র তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন...সেখানে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে কোন ইতিবাচক চিন্তা করা তো দূরের কথা, জীবনকে বাঁচার জন্য যে ধৈর্য্য দরকার তাই ধরে রাখা দুস্কর। কিন্তু নিকোলাই শিখিয়ে গিয়েছেন...বেঁচে থাকতে হয় কিভাবে।
"ইস্পাত"... ধাতুর একটি কঠিনরুপ। আর এটি আরো মজবুত, দৃঢ় কঠিন হয় আগুনে পুড়ে পুড়ে। মানবজীবন ঠিক তেমনিই এক উদাহরণ। মানুষ তত বেশি কঠিন, দৃঢ়, সক্ষম, শুদ্ধ, উজ্জ্বল এবং সুন্দর হয় যত বেশি জীবনের আগুনে সে দগ্ধ হয়।
অল্প বয়স থেকেই নিকোলাই জীবনের চরম বাস্তবতার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকেস। এক সময় রাশিয়ার বলশেভিক পার্টির নিবেদিত কর্মী হিসাবে শুরু করেন আরেক অধ্যায়। যোগ দেন রাশিয়ার রেড আর্মিতে। গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, অংশ নেন। কিন্তু সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মারাত্মক ভাবে আহত হোন। হারান দৃষ্টিশক্তি, হারান চলৎশক্তি। কিন্তু হারান নি যা...তা তার ইস্পাতের ন্যায় দৃঢ় মনোবল।
তিনি বলেছেন,
"জীবন মানুষের সবচাইতে প্রিয়। এই জীবন সে পায় মাত্র একবার বাঁচবার জন্য। এমনভাবে বাঁচতে হবে তাকে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার জন্য পরে যন্ত্রনাভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, যাতে বিগত জীবনের গ্লানিভরা হীনতার জন্য লজ্জার দগ্ধানি তাকে সইতে না হয়। এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে মৃত্যুর মুহুর্তে সে যেন বলতে পারে: আমার সমস্ত জীবন, সমস্ত শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য- মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামের আদর্শ"
আর তাই তো বলেছিলেন যখন অস্ত্রপাচারের জন্য তাকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং ডাক্তারেরা তাকে বলেছিলেন তিনি এখন সম্পূর্ণরুপে অক্ষম।
"এরা আমার অসুখ সম্বন্ধে যা যা বলছেন, সবই সত্যি। কিন্তু যখন এরা আমাকে কাজের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত বলে রায় দেবার চেষ্টা করেছেন, তখনই এদের মস্ত বড় ভুল হচ্ছে। এ সম্বন্ধে দেখা যাবে এখন।"
বলেছিলেন,
"কেউ কেউ আছে কুকুরের মতো অপমান সয়ে অসম্মানের মরণ মরে।"
তিনি এমনটা কখেনোও চান নি।
নিকোলাই যতদিন বাঁচতে চেয়েছিলেন, বাঁচার মত বাঁচতে চেয়েছিলেন। রেখে যেতে চেয়েছিলেন এমন কিছু যা পরবর্তী প্রজন্মকে, সংগ্রামী সাথীদের, জীবনের মূল্যবোধ শেখাতে হবে সহায়ক।
"মানুষ যখন লড়াই করবার মতো একটা আদর্শ খুঁজে পায়, তখন সে যেকোন কষ্ট সইবার মত বলিষ্ঠতা অর্জন করে।"
"মরবার মতো একটা সত্যিকারের আদর্শ থাকলে মানুষ মরতে ভয় পায় না। আদর্শই মানুষকে শক্তি জোগায়। যা করছো ঠিকই করছো- এটা জানা থাকলে তুমি হাসি মুখে মরতে পারো। এভাবেই লোকে বীর হয়ে উঠে।"

১৯৩৬ সালে প্রথম বই আকারে "ইস্পাত" মূল নাম "How the Steel was Tempered" প্রকাশিত হয়। মোট ৪৮ টি ভাষায় এটি অনুদৃত হয় এবং খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নেই ৪৯৫টি সংস্করণ হয়।
বই পড়া মানে শুধুই যে বিনোদন তা তো নয়, জীবনের মুল্যবোধ বোঝার পাথেয় হচ্ছে এই বই। আর "ইস্পাত" এর মতন মহান সৃষ্টি তার একটি উপাদান।
**************
লেখাটা শুরু করেছিলাম ভরদুপুরে। কাঠফাটা রোদ বিদায় নিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে বিকেলকে। শেষ করব আমার শ্রদ্ধেয় এই অমর জীবনবাদী সাহিত্যিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। নতুন করে উদ্দীপনা পেলাম জীবনের মূল্যবোধ বোঝার চেষ্টা করাতে। চলতে থাকাতে......

রবিবার, এপ্রিল ২৯, ২০১২

আমরা বাস্তববাদী....

আমরা দিনকে দিন মর্ডান হচ্ছি..ইয়ে যাকে বলে সভ্য, কালচার্ড। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভূক্ত গরীব দেশটিতো রীতিমত কালচার্ড। কে বলে পয়সা নাই!! পয়সা আছে। কড়কড়া নোটের গন্ধ, পয়সার ঝংকার সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন খাবারের দোকানেই শুনতে পাবেন। হাতে একটা কোক বা কোন এনার্জি ড্রিংকের ক্যান, হাফ প্যান্ট পরনে বড় সভ্য হয়ে একটা ভাব নিয়ে হেঁটে যাওয়া। কে বলে আমরা পিছিয়ে আছি!! 

অবশ্য বড় বড় বুলি আওড়াতে আমরা সবাই পটু। এই যেমন আমি...। স্পাইসি বার্গার মুখে দেবার সময় ভাবিনা কোন ৪ বছরের ছোট্ট শিশু চকলেট বিক্রি করে ক্লান্ত দেহে পার্কের কোন জায়গায় ঘুমিয়ে আছে। কোন খাবার পেটে আদৌও গিয়েছে কি না জানি না। আমি কিন্তু দিব্বি চালান করে দিয়েছি...রোস্টেড চিকেন উইথ চিলি সস্। হা হা.... After all I'm a cultured person... 

বাস্তব আসলেই ভিন্ন...কঠিন। বাপরে...তারচেয়েও কঠিন মানব চরিত্র। এই যেমন সেইদিনকার কথা। অ্যানিভার্সারিতে হাজব্যান্ড এর গিফট করা "The NoteBook" বইটি পড়ছিলাম। আবেগে একাকার..। তার সাথে গালিও দিচ্ছি কর্মাশিয়াল আমেরিকান এই "নিকোলাস ব্যাটা" লিখল কিভাবে এত ভয়ংকর সুন্দর সুন্দর ডায়লগ... তার মধ্যে কতক শেয়ার করবার লোভ সামলাতে পারছিনা। এই যেমন: 

"You are the answer to every prayer I've offered. You are a song, a dream, a whisper and I don't know how I could lived without you for as long as I have." 

"For me love like that has happened only once and that's why every minute we spent together has been seared in my memory. I'll never forget a single moment of it." 
"The reason it hurts so much to separate is because our souls are connected" 

"Silence is holy. It draws people together because only those who are comfortable with each other can sit without speaking. This is the great paradox" 

"You are the greatest thing that has ever happened to me" 

"I love you for many things, especially your passions, for they have always been those things which are most beautiful in life. Love and poetry and fatherhood and friendship and beauty and nature." 

আপাতত এখানেই ক্ষ্যান্ত দিলাম। তবে এধরনের বহু ডায়লগ আছে...যা প্রচন্ড আবেগ ছাড়া কলম দিয়ে বের করা সম্ভব নয়। যাই হোক..প্রচন্ড আগ্রহ ও আবেগ নিয়েই পড়ছি...নায়িকা অ্যালজাইমায় আক্রান্ত হয়ে স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে..নায়ক তাকে নিজেদের জীবনী পড়ে শোনায়। দিনের শেষে নায়িকার সব মনে পড়ে যে, কাহিনী শোনানো ব্যক্তিটিকে আসলে কে। খুব হাসি ও তৃপ্তি নিয়ে বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম। তারপর এক ধাক্কায় মুখের হাসি উধাও। কেননা, ছোট খাটো ভুলবার বাতিক সম্প্রতি আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে। এই নাম ভুলি তো কি বলব সেটা ভুলি। কখনো কখনো কাজও ভুলে যাই। "আমিও কি তাহলে ওমন হয়ে যাবো" এই ভয়ে বইয়ের সেই প্রচন্ড আবেগ এক সেকেন্ডে ভুলে গিয়ে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম। হা হা..একে বলে বাস্তব!! আর আমি একজন বাস্তববাদী। 

"ধৈর্য্য ধর, সবুর কর, মাথা গরম করবেনা, কেউ তোমাকে কষ্ট দিলে তাকে উল্টো কষ্ট দিবেনা...আত্মনং বিদ্ধি..আত্মনং বিদ্ধি..'"কত্ত জ্ঞানী টাইপের বুলি কপচাতে থাকি যখন তখন..কিন্তু ঠিক যখনই রাগ ঝাড়বার সুযোগ আসে...আহা বড় আনন্দ নিয়েই করি। যখন কাউকে কথা দিয়ে মারার সুযোগ আসে...লাফাতে লাফাতে সুযোগ গ্রহণ করি। তখন আর ওই ধৈর্য্য ধারন..মোহমায়া ত্যাগীভাব উধাও। ওসব ফিলোসফি পরে কোন সোস্যাল গ্যাদারিংয়ে ঝাড়বার জন্য তোলা থাকে। এটাই বাস্তব। 

জানি না আমি সভ্য হচ্ছি কি না...তবে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি এটা সত্য।

দলে যোগ দিচ্ছি...প্রহরী হবো

আওয়ামীলিগে যোগ দেয়াটা কিন্তু এখন খুব প্রয়োজনীয়....না না না... বলা চলে লোভনীয় প্রস্তাব। কেননা দেখেন না, স্বয়ং স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী দলীয় নেতা কর্মীদের হরতালে বিশৃংখলা রোধ করার জন্য জনপথে প্রহরীর ন্যায় ব্যাকআপ দিতে বলেছেন। কেননা তার পালিত নিরাপত্তা কর্মীরা অচল...তারা তো হরতাল চলাকালীন বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের রোধ করাতে প্রশিক্ষিত নয়। তারা পারে কষ্ট করে উদ্ধারকৃত প্রমানগুলো কাঁঠাল গাছে ঝুলিয়ে রাখতে। "মাথার উপর কাঁঠাল ভেঙে খাবার" এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরন!! 
যাই হোক...যোগ দিবো কি আনন্দে?? আরে ভাই এ তো লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া! কিছু পুলাপান আছে যাদের উপর আমার বেধম রাগ..গিয়ে ঠাস ঠাস গালে দুই তিনটা বসিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলব..."আওয়ামীলিগ করি...ব্যাটা প্রহরী আমি..সালাম ঠোক আর মাইর খা"..   

কোন সুস্থ্য (বাদ দিলাম)..শিক্ষিত মন্ত্রীর এমন উক্তিকে পজিটিভলি নিতে পারছিনা। হয়তবা জ্ঞানের অভাবেই আমার এমন দশা! কিন্তু দলে যোগ দিলে যে..লাভই লাভ এই লোভ আবার বড় বেসামাল করে দিচ্ছে আমাকে।   

আরেক ভদ্রলোকের, মির্জা ফকরূল ইসলাম এর বিনীত কষ্ট প্রকাশ দেখে একসময় বুঝতে পারলাম মুখে মাছি ঢুঁকেছে আমার। (এই মানে হা হয়ে গেলাম আর কি.  ) "জনগণের দুর্ভোগ হয় আমরা বুঝি কিন্তু বৃহৎত্তর স্বার্থে এই হরতাল কার্যক্রম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে"। তা জনাব এই হরতাল করে কি আন্দোলন করছেন! মানে বলতে চাইছি...কি উপকারটা হবে?? আমার গাড়ি পুড়বে..যে গাড়ি হয়ত আপনাদের মত কালারেবল অর্থ দ্বারা কেনা নয়, বহুত কষ্টের উপার্জিত অর্থের দ্বারা কেনা, আমার ভাই আগুনে জ্বলে কাবাবের মত হবে, আমার অসুস্থ বাবা হাসপাতালে যেতে না পেরে পথেই ইন্তেকাল, আমার দিনমজুর ভাই পেটে বাধবে একটা পাথর..ঘরের কোণে বসে বউ-বাচ্চা নিয়ে আনন্দ করবে!! সাধু... সাধু। 

কসম করে বলছি... এই আমি আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াবো যদি দেখতাম আপনাদের দলের গুম হয়ে যাওয়া নেতার জন্যে কষ্টে রাজপথে আপনি বা আপনার নেত্রী অনশনে বসেছেন। শুধু আমি কেন...আমার মতন আরো অনেক হাবলা গাবলারা আপনার পাশে দাঁড়াবে। বসেন...অনশনে বসেন। 
বিশ্বাস করব...যে নাহ..এই আন্দোলন আমাদের জন্যে, দেশীয় স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে। 

এমনিতেই ঘুমের সমস্যাতে ভুগি তার উপর যখন এতো তরতাজা জলন্ত আগুনের ন্যায় বক্তব্য শুনি...তখন মনে হয় যে......থাক্..ভাই-বোনেরা বুঝে নিন।  

রাজার দোষে....রাজ্য ডোবে না ভোগে এমন একটা কথা আছে নাহ?? 
ভাবছি...ভুল! আমাদের দোষেই আমরা ভুগি।

বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ০৫, ২০১২

ইসলাম - পীরবাদ ও কিছু মতাদর্শ.....(২য় এবং শেষ পর্ব)

গোপন জ্ঞান বা ইলম: 

সৃষ্টির সবকিছুরই সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ থাকে৷ এমনকি সৃষ্টিকর্তাও আছেন কি নেই তারও অজস্র প্রমাণ মেলে সারা জাহানে৷ ঠিক তেমনি গোপন কোন জ্ঞান বা ইলম থাকলে তারও প্রমাণ বা দলিল থাকে৷ কিছু ব্যক্তির মতানুযায়ী কোরআন শরীফ ৩০ পারা নয়, ৪০ পারা৷ ৩০ পারা প্রকাশ্য এবং বাকি ১০ অপ্রকাশ্য, গোপনীয় ইলম৷ যা নবীকরিম (সা: ) হয়ে, হযরত আলী (রা: ) হতে, হাসান বসরী হয়ে বিভিন্ন ওলী-আল্লাহ ও পীরদের সীনায় সীনায় চলে আসছে (নাউজুবিল্লাহ৷) 

"শরা লইয়া হুড়াহুড়ি
টের পাইলেন না আলেমগণে
কিছু পাইলা ফকিরগণে
বাতেনের ভেদত পীরে জানে৷" 


প্রথমেই বলব, ইতিহাসে এমন কোন প্রমাণ নাই যে, হযরত আলী রা: এর সাথে হাসান বসরী রহ: এর কখনো সাক্ষাত ঘটেছিল৷ গোপন জ্ঞানের ব্যাপারে কিছু ব্যক্তিদের বক্তব্য যে; হুযুর পাক (সা: ), হযরত আলী রা: কে কিছু গোপন জ্ঞান বা মারেফতের ইলম শিক্ষা দিয়েছিলেন যা অন্য কোন সাহাবীদের দেন নি৷ অন্য তিন প্রখ্যাত সাহাবী এর কোন খবরই জানেন না৷ এ বিষয়ে কোরআনের কিছু আয়াত উল্লেখ করছি, 

"কোন কিছু গোপন করা নবীর কাজ নয়৷"
(সূরা আলে ইমরান: আয়াত:১৬১) 

"হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবর্তীণ করা হয়েছে তা সকলের নিকট পৌঁছে দাও৷ আর যদি তা সঠিকভাবে পৌঁছে না দাও তাহলে রিসালাতের দায়িত্বকেই পালন করলে না৷" 
(সূরা মায়িদা: আয়াত: ৬৭) 

এরপরও কোন সুস্থ্য মস্তিস্কের, ইসলামের প্রতি বিশ্বাসী মানুষের আদৌও উচিত্‍ হবে এটা ভাবা যে, নবী করিম কোরআনের ১০ পারা ইলম গোপন করেছেন!!! 

এই গোপন জ্ঞানের ইতিহাস সংক্ষেপে বলতে গেলে, বাউলদের জনশ্রুতিমতে, চৈতন্যদেবের একটি গুহ্য সাধণপ্রণালী ছিল, যা চৈতন্যদেব স্বয়ং মুসলমান আউলচাঁদরুপে পুনরাবির্ভূত হয়ে সাধারণের মধ্যে প্রচার করেছেন৷ এবং পরে সম্ভবত আউলচাঁদের শিষ্যা মাধববিবি এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্র বা বীরচন্দ্র এই গোপন সাধনতত্ত্ব প্রচার করেন৷ অন্যথায়, অবিভক্ত বাংলায় শ্রীচৈতন্যের লীলাক্ষেত্র বৈষ্ণবদের অনুকরণে একটি দলের আবির্ভাব ঘটে৷ শ্রীচৈতন্য একজন দার্শনিক ছিলেন৷ তাঁর যুক্তিতর্ক ও দর্শনের প্রভাবে দলে দলে মুসলিমরা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে৷ এমতাবস্থায় তাঁর দর্শনকে খন্ডন করার জন্য নদীয়ার শান্তিপুরের নিকট বুড়ল গ্রামের মুনশী আবদুল্লাহ গেল শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে 'বাহাস' করতে৷ সেই বাহাসে পরাজিত হয়ে মুন্সী আবদুল্লাহ বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করে চৈতন্যদেবের শিষ্য হয়ে গেলেন, তার নাম রাখা হলো যবন হরিদাস৷ এই যবন হরিদাসই হলো গোপন দশ পারা এবং ষাট হাজার গোপন কথার আবিস্কারক৷ এইসব গোপন জ্ঞানে এমনসব চর্চা বা কর্মের কথা বলা হয়েছে যা লিখবার মত নয়, তবে একটা কথা এখানে স্পষ্ট হওয়া উচিত্‍, আল্লাহ যা আমাদের জন্য হারাম করেছেন তা হারামই আর যা হালাল করেছেন তা হালালই৷ 

কিছু ব্যক্তি কোরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন৷ তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, সহীহ বোখারী শরীফের "এলেম বা জ্ঞানের পর্ব" পৃষ্ঠা ৬৩, ১২২ নং হাদীস৷ এখানে আছে- 

"হযরত আবু হোরায়রা (রা: ) হতে বর্ণিত, আমি হুযুর (সা: ) থেকে দু'ডোল এলেম হেফজ করেছি৷ তার মধ্য থেকে এক ডোল আমি তোমাদের কাছে সাধারণভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি, কিন্তু যদি আমি দ্বিতীয় ডোল এলেম বর্ণনা করি, তা হলে আমার এ (হলকুম) কন্ঠনালী কেটে দেয়া হবে৷ অথর্াত্‍ আমাকে হত্যা করা হবে৷" 
এ হাদীস হতে গোপন জ্ঞানের একটি আভাস পাওয়া গিয়েছে বলে তাদের মত৷ কিন্তু ১১৯ নং হাদীসটি লক্ষ্য করলেই এর জবাব পাওয়া যায়, যেখানে উল্লেখ্য হযরত আবু হোরায়রা রা: বেশি বেশি হাদীস এই জন্য রেওয়াত করতেন কেননা কোরআনে উল্লেখ্য যে, আল্লাহতালা সুস্পষ্ট যুক্তি ও পর্থনির্দেশ নাযিল করেছেন এবং বিশদ বর্ণনা করার পরও যারা তা গোপন রাখেন এবং অন্যেকে না শেখান তবে তার প্রতি আল্লাহর লানত৷ 
যাই হোক্, প্রকৃতপক্ষে ১২২নং হাদীসটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় (বোখারী শরীফ; বাংলা তরজমা ও ব্যাখ্যা সহকারে; হামিদিয়া লাইব্রেরী লিমিটেড প্রকাশিত; সংস্করণ ১লা মার্চ ১৯৯৬ইং; পৃষ্ঠা ১১২; ৯৫ নং হাদীসে ) যে, 

"দ্বিতীয় থলিয়ায় কি প্রকারের এলম ছিল তাহার জন্য কাহারও মাথা ঘামাইতে হইবে না৷ স্বয়ং সাহাবী আবু হোরায়রার নানা প্রকার ইঙ্গিতেই উহা প্রকাশ পায়৷ রাসুল্লাল্লাহ, সাহাবী, খোলাফা বা শাসনকর্তাদের পর হইতে যে সমস্ত বিপথগামী ও অত্যাচারী শাসকদের আবির্ভাব হইবে, রাসুলপাক সে সকলের নামঠিকানা ও সময়ের ভবিষ্যদ্ববাণী করিয়াছিলেন৷ ঐ সকল নাম-ঠিকানা আবু হোরায়রার কন্ঠস্থ ছিল৷ সাহাবী শাসনকর্তাদের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরে ঐ সমস্ত বিপথগামী শাসকদের সময় নিকটবর্তী হইলে পর আবু হোরায়রার মনে সব কিছু জাগিয়া উঠে৷ কিন্তু ইহা প্রকাশে ফল হইবেনা বরং শান্তিশৃঙ্খলা বিপন্ন হইবে, তাই তিনি ঐ সবের বর্ণনা হইতে বিরত থাকেন৷" 

গোপন এলম বিষয়ক আরেকটি হাদীস হচ্ছে - "হযরত আবু হোরায়রা (রা: ) বলেন; হুযুরপাক (সা: ) ইরশাদ করিয়াছেন- যাহার কাছে এলেমের কোন কথা জিজ্ঞেস করা হয় আর সে উহা (জানা সত্ত্বেও) গোপন করে, আল্লাহতালা কেয়ামতের দিন তাহার মুখে আগুনের লাগাম পরাইয়া দেবেন৷" 
(আবু দাউদ, সুত্র: মুন্তাখাব হাদীস; এলেম ও যিকির অধ্যায়; ৩৪২ পৃষ্ঠা) 

এরপরও যদি বলা হয়, হুযুরপাক কোন গোপন এলম শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন তাঁর মনোনিত ব্যক্তিদের, তবে তাঁর প্রতি পক্ষপাতিত্ত্বের অভিযোগ করা ছাড়া আর কিছুই হবে না৷ কেননা, গোপন এলেম নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মূল্যবান ও অর্থবহুল যা থেকে অন্যান্য তিন সাহাবীকে তিনি বঞ্চিত করেছেন৷ (আস্তাগফিরুল্লাহ) 

এলেম বা জ্ঞান শিক্ষা আবশ্যক৷ মারেফতের তরজমা না বুঝলে ঈমান পরিপূর্ণ হয়না। আল্লাহপাক এটি সবার জন্য ফরয করেছেন৷ আর এখানে গোপন জ্ঞান বা এলেমকে অস্বীকার করা হচ্ছে না। বরং গোপন জ্ঞানের নামে যে তরিকাগুলোর উদ্ভাবন এবং পালন করতে বলে তথাকথিত কিছু ভন্ড ব্যক্তিরা, যারা ইসলামের পবিত্রতা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই করে না। পাক কোরআনে মূসা আ: এর সাথে খিযির রা: এর সহিত যে মোলাকাত হয় এবং তার যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে খুব স্পষ্টতই বোঝা যায়, খিযির রা: ভূত-ভবিষ্যত দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। আর এটাতো এলেমই। এই জ্ঞান কি সবার পক্ষে অনুধাবন এবং ধারন করা সম্ভব!! 

আমাদের হুযুরপাক তাগিদ দিয়েছেন আমল শক্ত করবার, এলেম অর্জন ও ধারন করবার জন্য যোগ্য পাত্র হবার। অন্যথায় ভুল পাত্রের এলেম ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই করেনা। বাতেনী বা অপ্রকাশ্য জ্ঞান কিরুপ তা উপোরক্ত উল্লেখ করেছি। আমাদের উচিত্‍ নিজেদের কালব, যিকিরের দ্বারা পরিস্কার করা এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করা এলেম হাসিল করা৷ কেননা কোরআন শরীফে আছে-

"যাঁহারা ঈমান আনিয়াছেন এবং বিশেষত: এলেম হাসিল করিয়াছেন আল্লাহতালা তাঁহাদিগকে অনেক উচ্চাসনের অধিকারী করিবেন" 
(পারা ২৮; রূকু ২) 


মহান আল্লাহর নৈকট্যের পথ: 

প্রায়ই শুনেছি কিছু মানুষ আছেন যারা বলেন, আমরা শরীয়তপন্থি এবং উনারা মারেফতপন্থি৷ ভালো কথা, তাহলে এই বিষয়টি একটু পরিস্কার হওয়া উচিত্‍ যে শরীয়ত ও মারেফত সমান নয়৷ অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন কোন রাস্তা নয়, যে আমি এই রাস্তা দিয়ে যাবো, আপনি ওই রাস্তা দিয়ে যাবেন৷ কে আগে বা আদৌও পৌঁছাতে পারে কি না, দেখা যাক্!! পাঁচতলা বিশিষ্ট দালানের উপর উঠতে হলে আমাকে ১,২ করে সিড়ি ভাঙতে হবে, ধাপে ধাপে এগুতে হবে৷ ১ম তলা বাদ দিয়েই ৩য় কিংবা ২য় তলাতে উঠা সম্ভব?? এখানেও বিষয়টি কিছুটা তেমনই৷ 

মারেফত
হকিকত
তরিকত
শরীয়ত 


খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে ব্যাপারটি হচ্ছে শরীয়ত আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-নিষেধ, হুকুম আহকাম৷ একজন ব্যক্তি যখন সকল প্রকার হুকুম আহকাম মেনে চলতে থাকবে অর্থাত্‍ জাহেরী ও বাতেনী এলেম অর্জন করে ফেলেন, তিনি তখন একাকীই তরিকা শিখে যান, অর্থাত্‍ কি প্রকারে এবং কখন আল্লাহর ইবাদত করাটা মোক্ষম সময়৷ (এখানে ওলী-আল্লাদের জীবনী উজ্জ্বল উদাহরণস্বরুপ) হুযুরপাক আমাদের রাত্রিকালীন ইবাদত করবার প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন৷ আর এর জন্যেই হয়তবা বলা হয়ে থাকে যে, আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যত সাধক, আওলিয়া আধ্যাত্মিক দৌলত লাভ করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এই রাত্রিকালের সাধনা ও আরাধনার দ্বারাই সব কিছুর সন্ধান পেয়েছেন৷ কোন চাকরির আশায় আমিও আবেদন করব, আপনিও করবেন৷ আপনি যদি এক্ষেত্রে আমার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন তবে আপনি জানবেন কিভাবে, কোন ভাষায় লিখলে আবেদন বেশি গ্রহণযোগ্য হবে৷ ঠিক তেমনি ইলম চর্চা করতে থাকলে তরিকা আপনাতেই শিখে যাবেন৷ 
এক্ষেত্রে আবারো একটা কথা উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে, আমার আব্বা বলেন, 'আল্লাহপাক বলেছেন, সেজদায় আমি আমার বান্দার মাঝে কোন পর্দা রাখিনা, অতএব, দোয়া করতে চাইলে মোনাজাতের চেয়ে উত্তম হবে তুমি সেজদায় গিয়ে চাও'৷ এটা কিন্তু একপ্রকার তরিকাই বটে৷ 

বিভিন্ন মোক্ষম তরিকায় ইবাদত করতে থাকলে একসময় নেক্কার ঈমানদার বান্দা হকিকত জানতে পারে৷ অর্থাত্‍ আত্মদর্শন ঘটে৷ আয়নার মত নিজের প্রতিচ্ছবি তার কাছে প্রতিফলিত হয়৷ সৃষ্টির গুঢ় রহস্য উন্মোচন হয়৷ যা গোপনীয়৷ কেননা, সৃষ্টির সবকিছু আমাদের জানা নেই, আবিস্কার করছি মাত্র৷ সেই গোপন রহস্য অর্থাত্‍ সৃষ্টির গোপন রহস্য জানা যায়, হকিকত কি তা বোঝা যায়৷ তারপরেই ঘটে মোক্ষম মুক্তি, মারেফত৷ অতএব, এই মারেফতের রাস্তা এত সহজ নয়৷ ঈর্ষা, হিংসা, মোহহীন কোন কালব তৈরি করা কি এতই সহজ!!! 

মারেফতের কিছু কথা আছে যা দৃষ্টত্য শরা-শরীয়তের খেলাফ বলে মনে হবে৷ এক্ষেত্রে আবারো আমার আব্বার কাছ থেকে শেখা, মারিফতি একটি বয়ান উল্লেখ করতে চাই৷ 
যা হচ্ছে: 

"চুরি করুম, হারাম খামু
নাচতে নাচতে বেহেশতে যামু৷" 


বলা হচ্ছে, চুরি করে এবং হারাম খেলেই বেহেশত পাওয়া যায়! নাহ্, ব্যাপারটি আসলে তা নয়৷ এর কিন্তু অপব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব৷ প্রকৃতপক্ষে গুঢ় অর্থ হচ্ছে, "চুরি করুম", আপনি সবার সাথে বসে গল্প করছেন, আড্ডা দিলেন৷ রাত গভীর হয়ে যাচ্ছে, সবাই ঘুমাতে চলে গেল, আপনিও গেলেন৷ সবাই ঘুমিয়ে পরল, কিন্তু গভীর রাতে আপনি জায়নামায পেতে বসে গেলেন ইবাদত বন্দেগীতে, যার সম্পর্কে কেউ অবগত নয়৷ সকালে আবার যার যার মত কাজে লেগে গেলেন৷ আপনার গভীর রাতের কর্ম সম্পর্কে কেউ জানতে পারলনা৷ এইভাবে আপনি করলেন চুরি৷ "হারাম খামু", আমরা সবাই জানি 'রাগ'... 'ক্রোধ' হচ্ছে 'হারাম'৷ আপনার অত্যাধিক রাগ উঠেছে, এই ক্রোধকে বের না করে আপনি অবদমিত করলেন অর্থাত্‍ গিলে ফেলা যাকে বলে৷ তাহলে আপনি কি হারাম খেলেন না! 

কাজেই এইভাবে আপনি যদি চুরি করেন এবং হারাম খেতে থাকেন তবে ইনশাল্লাহ মহান রাব্বুলআলামীন বেহেশতের দরজা আপনার জন্য খোলা রাখবেন৷ 


অবশেষে বলব, এলেম বা জ্ঞান অর্জন করা যায়, হাসিল করা যায়৷ কিন্তু আলেম বা জ্ঞানী হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সবাই হয়ওনা৷ কেননা এলেম জানলেই হয়না, আমলও করতে হয়৷ যেমন আমরা খুব স্পষ্ট করেই জানি ক্রোধ, হিংসা, দ্বেষ, অহং, কাম, লোভ, মায়া এসকল প্রবৃত্তিই সবচাইতে বড় শত্রু, বাঁধা৷ আত্মিক উন্নয়নের পথে চরম অন্তরায়৷ এবং আমরা তা জানার পরও চেষ্টা করিনা এর ভয়াবহ বলয় থেকে নিজেদের মুক্ত করার৷ কাজেই এই প্রবৃত্তিগুলোকে যদি দমন করতে না পারি তবে আমাদের আত্মিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়৷ কাজেই দোয়া রইল, আল্লাহ যেন আমাদের এলেমের পথ খুলে দেন, এলেম হাসিল করবার শক্তি দেন এবং আলেম হবার তৌফিক দান করেন৷ আমিন৷ 


তথ্যসুত্র: 
১. বোখারী শরীফ; বাংলা তরজমা ও ব্যাখ্যা সহকারে; হামিদিয়া লাইব্রেরী লিমিটেড প্রকাশিত; সংস্করণ ১লা মার্চ ১৯৯৬ইং;
২. সহীদ বোখারী শরীফ, বাংলা তরজমা, সোলেমানিয়া বুক হাউস হতে প্রকাশিত, সংস্করণ বইমেলা ২০০৬ইং;
৩. মুসলিম শরীফ;
৪. তিরমিযি শরীফ;
৫. দৈনন্দিন ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন;
৬. মুন্তাখাব হাদীস;
৭. পীরবাদের বেড়াজালে ইসলাম- অধ্যাপক এ.এফ.ছাদুল হক ফারুক;
৮. বাউল ও সুফি সাহিত্য- ড. আহমেদ শরীফ
৯. মোকসুদুল মোকমিনিন 

ইসলাম-পীরবাদ ও কিছু মতাদর্শ....(১ম)

(প্রথমেই বলে নেবো, ধর্ম বিষয়ের উপর কোন স্কলার আমি নই৷ কাজেই ভুলত্রুটি থাকতেই পারে স্বাভাবিকভাবে৷ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি৷ তবে প্রবন্ধটি লেখার সময় যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি বিভিন্ন রেফারেন্স দেবার৷ ) 


পীরবাদ ইসলামবর্জিত ভিন্ন একটি দর্শন: 
কিছু কিছু বিষয় থাকে যা সত্যিই খুব স্পর্শকাতর হয়, যেমন: ধর্ম৷ যোগ্য উদাহরণ হিসাবেই বলা চলে কেননা আজ পর্যন্ত এই বিষয় ঘিরে সমালোচনা হয়েই আসছে এবং চলবেই৷ কখনো কখনো এই ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা (সঙ্গত কারণেই সমালোচনা বলবনা) সমুচিত নয় আবার কখনো উচিতও৷ কেননা আলোচনা না করলে একে বোঝাও যায়না এবং সাথে করে এর ব্যাপ্তি বা প্রসার রোহিতও হয়৷ একে বোঝার সীমাটা সংকুচিত হয়ে আসে আপনাতেই, যদি না আলোচনা না হয়৷ আর এটাই স্বাভাবিক৷ 

মুসলমান গোষ্ঠির ধর্ম "ইসলাম" এ সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে এর আধ্যাত্মিকতা৷ ইসলামে প্রথম কথাই হচ্ছে "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" অর্থাত্‍ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবূদ নাই৷ একক ও অদ্বিতীয়, তিনি লা শরীক এবং এটাই তাওহীদ৷ ইবাদত বন্দেগীর ব্যাপারে তাঁর কোন শরীক নেই৷ অতএব, এখানে দৈত্ববাদের কোন প্রশ্নই উঠেনা৷ আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাস রেখেই প্রদত্ত বিধি-বিধান মেনে জীবন যাপন করাই ইসলামের মূল৷ 

এই ইসলামে ইলম বা জ্ঞান দুই প্রকার৷ 
(ক) জাহেরী (প্রকাশ্য); 
(খ) বাতেনী (অপ্রকাশ্য)৷ 


জাহেরী জ্ঞানগুলো হচ্ছে তাওহীদ, নামায, রোজা, হজ্ব ও যাকাত৷ আল্লাহ প্রদত্ত বিভিন্ন বিধি-নিষেদ, হুকুম-আহকাম৷ যা প্রকাশ্য৷ এবং বাতেনী ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে কাম, ক্রোধ, হিংসা, দ্বেষ, লোভ, মোহ, মায়া ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় দ্বারা মনকে কলুষিত হতে না দেয়া, কলবকে পরিস্কার রাখা৷ ঈমানদার ও তাকওয়া অর্জনকারী হতে হলে কলবকে কলুষিত মুক্ত রাখতে হবে৷ এই বাতেনী জ্ঞান বা চর্চাই হচ্ছে ইলমে তাসাউফ৷ তাসাউফের জ্ঞান অর্জন না করলে পরিপূর্ণ ঈমানদার কখনোই হওয়া যাবেনা৷ এজন্য হুযুরপাক হযরত মুহাম্মদ (সা: ) স্পষ্ট করেই বলেছেন: 

"জেনে রেখো! শরীরের মধ্যে এক টুকরো গোশত আছে, যদি তা পরিশুদ্ধ হয়, তবে গোটা শরীরই পরিশুদ্ধ হয়৷ আর যদি তা খারাপ হয়, তবে সমস্ত শরীরই খারাপ হয়৷ মনে রেখো, তা হলো কালব বা দিল৷" 
(বোখারী ও মুসলিম শরীফ) 
কিন্তু আমাদের সমাজের কিছু লোক (অশিক্ষিত গোঁড়া এবং শিক্ষিত গোঁড়া) এই অপ্রকাশ্য বা বাতেনী জ্ঞান বা ইলম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতার্দশ রাখেন৷ যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের সুস্থ্যধারাকে প্রতিনিয়ত ব্যাহত করে৷ একটি মতার্দশ হচেছ পীর ও মুরিদী চর্চা৷ একে ইসলাম সম্পর্কহীন দর্শন বলব শুধুমাত্র এই কারণগুলোর জন্যই: 

১. পীর না ধরলে আখিরাতে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়৷
২. পীরকে ভজতে হবে আগে৷ আমল করবার সময় পীরের চেহারা মনে করে আমল করতে হবে৷
৩. পীরকে ভজলেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য বা নৈকট্য লাভ করা যায়৷ কোরআন হাদীসের আগে পীর সত্য ও বড়৷
৪. পীরের মাযার মানা এবং পীরের নামে মান্নত করে চাইলে তা পূরণ হয়৷
৫. পীরকে ঔসিলা করে চাইলে মনোবাসনা পূরণ হয় এবং পীর মুরিদের, আখিরাতের সকল দায়-দায়িত্ব নেয়৷ 


পীরবাদের ভিত্তিগুলো, ইসলামের মূল কথা "আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবূদ নাই" এর সাথে কোনভাবেই খাপ খায় না বিধায় একে ইসলামসম্পর্কহীন দর্শন বলতে হবে৷ তার আগে "পীর" এই নামটি বা দর্শন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু জেনে নেয়াটা দরকার৷ 


পীর: 
পীর শব্দটি একটি ফারসি শব্দ৷ কোরআন ও হাদীসের পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত কোন শব্দ নয়৷ পারস্যের অগ্নিপূজারীদের পুরোহিতকে পীরে মুগাঁ বলা হতো৷ অন্যদিকে পানশালার মদ বিক্রেতাকেও "পীরে মুগাঁ" বলা হতো৷ কেননা আধ্যাত্মিক প্রেমকে রুপকভাবে মদের সাথে তুলনা করা হয়৷ ফারসি এই কবিতায় আছে: 

"বমায়ে শাজ্জাদাহ রঙ্গীন কুন
গিরাত পীরে মুগাঁ গোয়াদ
সে সালেক বেখবর নাবুদ
যে রাহে রাসমো মানযিলহা৷" 

অর্থাৎ: পীরে মুগাঁ বা শুড়ী মশায় যদি বলেন, তাহলে তুমি জায়নামাযকে মদের দ্বারা রাঙিয়ে তুলো৷ কেননা, পথের সন্ধান গুরুজী ভালভাবেই অবগত আছেন৷ 

পীরকে মুর্শিদও বলা হয়৷ তবে মুর্শিদ বলা হয় বাউল তত্ত্বের পরিভাষায়৷ আর মুরীদ হচ্ছে শিষ্য৷ যারা পীরকে শিক্ষক হিসাবে গ্রহণ করে, পীরের হাতে হাত রেখে ওয়াদা করেন৷ অর্থাত্‍ বায়াত গ্রহণ করেন৷ এদের কথায় এরা শরীয়তপন্থি নয় মারেফতীপন্থি এবং বিভিন্ন তরিকায় ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে থাকেন৷ 

জীবনের পথে যেকোন জ্ঞানার্জন শিক্ষককে অস্বীকার করে সম্ভব নয়৷ একজন শিক্ষকের দারজা বা মাহাত্ব্য, মা-বাবা পরেই, তা হুজুরপাক খোদ নিজ মুখে বয়ান করেছেন৷ অতএব কোন গুরু বা শিক্ষক ছাড়াই এলম অর্জন করা যায় তা দাবী করাও, চরম মুর্খতার পরিচয় দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়৷ কিন্তু এখানেই কথা, পরীক্ষায় বসব আমি, খাতায় লিখব আমি এবং তার ফলাফলও হবে একান্তই আমার৷ আমার শিক্ষক বা গুরু আমাকে বড়জোর পথ বাতলে দিতে পারেন যে, কোনভাবে পড়লে, লিখলে ফলাফল ভালো হতে পারে৷ পরীক্ষার খাতায় উনি লিখে দিতে পারবেন না৷ ঠিক তেমনি কোন পীর তার মুরীদের শাফায়াতের সকল দায়-দায়িত্ব নিতে পারেন না৷ 

আর এর জন্যেই বলা হয়েছে: 

"ওয়ামা খালাকতুল জিন্নাহ ওয়াল ইনছা ইল্লা লিয়া'বুদুন" 
অর্থাৎ, আমি জি্বন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি এজন্যেই যে তারা আমার ইবাদত বন্দেগী করবে৷ 
(সূরা যারিয়াত: ৫১:৫৬)
অতএব, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী প্রত্যেক বান্দাকেই নিজ নিজভাবে করে যেতে হবে৷ কারোও ইবাদত কেউ করে দেয়না৷ অনেক মুরীদগনই বলেন যে, নামায তাদের পড়তে হবে না কেননা, তাদের নামায তাদের পীরই পড়বেন৷ তাদের শাফায়াত করবেন তাদের পীর৷ যদি তাই হয়, তবে আমাদের অর্থাত্‍ শেষ নবীর উম্মত যারা, তাদেরতো কোন আমল করবারই প্রয়োজন পরেনা৷ কেননা মাকামে মাহমুদে অর্থাত্‍ প্রশংসনীয় স্থানে অবস্থান করবার একমাত্র হকদার হুযুরপাক নবীকরিম (সা  এবং আমরা তাঁর উম্মত৷ 

"আছা আই ইয়াব আছাকা রাব্বুকা মাকামাম মাহমুদা৷" 
(সূরা বনী ইসরাইল: ১৭:৭৯) 
অর্থাৎ, আশা করা যায়, আপনার রব আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন মাকামে মাহমুদে (প্রশংসিত স্থানে)৷ 

শাফায়াত দুই প্রকার হয়ে থাকে৷ শাফায়াত কুবরা, যা শুধুমাত্র নবীজীর জন্য এবং শাফায়াত সুগরা যা অন্যান্য আলেম বুজুর্গ, ওলী আল্লাহদের জন্য৷ 

হাদীসে আছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা: ) হতে বর্ণিত রাসূল (সা: ) ইরশাদ করেন- "প্রত্যেক নবীকে একটি করে দোয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ যে দোয়া আল্লাহপাক অবশ্যই কবুল করবেন৷ সকল নবী তাঁদের দোয়া করে ফেলেছেন৷ আর আমি আমার দোয়াটি কেয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফায়াতের জন্য রেখে দিয়েছি৷" 
(মুসলিম শরীফ (বাংলা) ১ম খন্ড, ৩৮৬নং হাদীস) 
কাজেই উপরোক্ত অঙ্গীকার থেকে এটা তো স্পষ্টই যে, হুযুরপাক আমাদের জন্যে শাফায়াত করবেন৷ তবে কি আমাদের আমল করা ছেড়ে দেয়া উচিত্‍ নয়!!! 


"লক্ষ্য কোটি সুরত নিয়ে
সাজলে তুমি নিরাকার
প্রভু, সাজলে তুমি নিরাকার৷" 



ইসলামে "ইহসান" এর কথা বলা হয়েছে৷ "ইহসান" একটি আরবী শব্দ৷ যার অর্থ হচ্ছে সুন্দর ব্যবহার৷ মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় উত্তমরুপে ইবাদত করা এবং তাঁর সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করা৷ কোরআন শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে: 

"যে ব্যক্তি ইহসানকারীরুপে আল্লাহর নিকট একান্তভাবে আত্মসমর্পণ করে, সে তো মজবুত হাতল ধারণ করে, আর সমস্ত কাজের ফলাফল তো আল্লাহরই ইখতিয়ারে৷" (সূরা লুকমান: ৩১:২২)
ইবাদতকারী ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই ইবাদত করবে৷ এ প্রসঙ্গে হুযুরপাক বলেছেন: 

"তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছো, আর তুমি আল্লাহকে দেখতে না পেলে অন্তত এটা ভাববে যে, তিনি তো তোমাকে দেখছেন৷" 
(মুসলিম শরীফ, সুত্র মিশকাত:১১ পৃষ্ঠা) 

এখানে ইবাদতের সময় কনসেনট্রেশনের কথা বলা হয়েছে৷ অর্থাত্‍ এক আল্লাহতে, কেন্দ্রতে চিন্তাকে আবদ্ধ করা এবং এটা স্বাভাবিক কেননা, পড়ার সময় যদি চিন্তা পড়ার উপর না থাকে তবে সেই পড়াটা আত্মস্থ হয়না, খাওয়ার সময় যদি চিন্তা অন্য কোথাও থাকে তবে খাবারটাকে উপভোগ করাও যায়না৷ আর এরজন্যই উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণিত৷ ইবাদতের সময় সম্পূর্ণ মনোসংযোগ দিতে হবে৷ কিন্তু তাই বলে এটা নয়, ইবাদতের সময় আল্লাহকে কোন ব্যক্তিরুপে চিন্তা করে নিতে হবে৷ তাহলে তা শিরকের পর্যায়ে চলে যায়৷ যখন আমি আমার পরীক্ষকের সামনে বসে পরীক্ষা দেই তখন তার দিকে তাকিয়ে খাতায় লিখি না৷ বরং স্পষ্ট অনুভব করি যে আমার পরীক্ষকের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ৷ এই "অনুভব" এর কথাটাই রাসূলকরিম বোঝাতে চেয়েছেন৷ 


"মন পাগলরে গুরু ভজনা
গুরু বিনে শান্তি পাবে না৷
গুরু নামে আছে সুধা
যিনি গুরু তিনিই খোদা
মন পাগলারে গুরু ভজনা৷" 


পীরকে ভজলেই আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভ করা যায়! যদি পীর ভজনই সব তবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের কি দরকার, যেহেতু কোরআন হাদীসের আগে পীর বড় এবং সত্য (নাউজুবিল্লাহ)৷ আল্লাহতালা বলেছেন: 

"আমি এ জন্যই রাসূল প্রেরণ করেছি যেন আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তাঁর আনুগত্য করা হয়৷" (সূরা নিসা: ৪:৬৪) 
আরোও বলেছেন, 

"কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল৷" 
(সূরা নিসা: ৪:৮০) 

এর অর্থ কিন্তু আহাদ ও মুহাম্মদ এক, তা নয়৷ নবী-রাসূলগণ নিষ্পাপ৷ এবং সবচাইতে নিষ্পাপ হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবীকরিম (সা: )৷ আল্লাহ তাঁকে দ্বিধাহীনভাবে অনুসরণ করতে বলেছেন৷ আর কোরআন হাদীস অমান্য করে যদি পীরের দারজাই বড় হয়ে থাকে (পীরের কথাই সবার আগে!) তবে, এটা সরাসরি হুযুরকে অবিশ্বাস করা, সর্বোপরি আল্লাহর নির্দেশ কোরআনকে অমান্য করা৷ শিরকি এবং গোনাহ ছাড়া এটা আর কিছুই না৷ 


বলা হয়, পীরদের নামে মান্নত করে কিছু চাওয়া কিংবা ঔসিলা করে চাইলে (পীর বা পীরের মাযারের নামে) তা পূরণ হয়৷ এবং এর সত্যতা প্রমাণের জন্য পীর/মুরীদগণ কোরআনের আয়াতের কিছু অপব্যাখা দেন৷ কোরআনে একটি আয়াত আছে: 

"ইয়া আইয়ু্যহাল-লাযীনা আ-মানুত্তাকুল্লা হা ওয়াবতাগু ইলাইহিল ওয়াসীলীহাতা ওয়া জা-হিদু ফী ছাবিলিহি লা আল্লাকুম তুফলিহুন৷" 
(সূরা মায়েদা: আয়াত ৩৫) 
অর্থাত্‍ হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর সান্নিধ্য অন্বেষণ কর ও আল্লাহর পথে জিহাদ করতে থাকো৷ আশা করা যায় যে, তোমরা সফলকাম হবে৷ 

এখানে "ওয়াসীলা" শব্দটির অর্থ "মাধ্যম"৷ আর পীরবাদীদের এখানেই জোর দাবি যে, উল্লেখিত মাধ্যমই হচ্ছেন তারা৷ যদি তাই হয়, তবে রাসুলপাকের জমানায় মক্কার কাফের মুশরিকরা কিছু মুর্তির উপাসনা করত এবং তাদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তারা বলে: 

"আমরা ঐ সমস্ত মুর্তিগুলোর ইবাদত এজন্যেই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়" 
(সূরা ফাতহ: আয়াত:৬) 

তাহলে এখানেও ওয়াসিলা করে প্রার্থনা করা হচ্ছে৷ এটা কি মিলে যাচ্ছেনা?? 

এটা বলবনা যে, ওয়াসিলা করে দোয়া করা হারাম৷ নাহ্, তবে সঠিকভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে যেমন: ঈমানের ওয়াসিলা করে দোয়া চাওয়া, আল্লাহতালার নামের ওয়াসীলায়৷ যেমন: 

"আল্লাহতালার রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ৷ অতএব, ঐ নামগুলির মাধ্যমে তাঁকে ডাক৷" 
(সূরা আরাফ, আয়াত: ১৮০) 

নেক আমলের ওয়াসীলা করে প্রার্থনা করা, যেমন: রাসুলপাক (সা: ) ইরশাদ করেছেন- 

'তোমার মনের ইচ্ছাকে পূরণ করতে অধিক সিজদাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ কর৷'
(মুসলিম শরীফ) 

আল্লাহর রাসুলের ওয়াসিলায়৷ এক্ষেত্রে একটা কথা উল্লেখ করছি, আমার আব্বা যখন মোনাজাত করেন তখন বলেন-'আমাদের রাসুলপাক যেসব কল্যাণ চেয়েছেন, আল্লাহ আমাদের সেইসব কল্যাণ দান কর এবং যেসব অকল্যাণ থেকে মুক্তি ও পানাহ চেয়েছেন সেসব অকল্যাণ থেকে আমাদের হেফাজত কর৷' 
ব্যক্তিসত্ত্বার দালালী ইসলাম অনুমোদন করে না৷ কিন্তু পীরবেশধারী ব্যক্তিরা "ওয়াসিলা" হওয়ার দাবীর মাধ্যমে সরল সাধারণ নিরীহ মানুষদের প্রতারিত করতে থাকে প্রতিনিয়ত, তাদের দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে৷ সাধারণ মানুষগুলো অন্ধ হয়ে পীরের জন্য চাল, অর্থ যোগাড় করে, পীরের পা টেপা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেবা প্রদান করে (যেখানে আমাদের হুযুরপাক তাঁর কদম মোবারকে কোন সাহাবীদের হাত দিতে দেন নি), যেখানে নিজ গৃহে হয়ত তাদের অসুস্থ মায়ের সেবা করারও তাদের সময় ও ইচ্ছে হয় না৷ 


মান্নত করে চাওয়াটা বিশেষত আমাদের দেশে এখন প্রায় একটি কালচারের মতই দাড়িয়েছে৷ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত দু'দলের মধ্যেই দেখা যায় যে, কিছু হলেই মান্নত করা হয়৷ এই মান্নতও দুইভাবে করা যায়৷ ১/ শরীয়ত সম্মত মান্নত এবং ২/ শিরকযুক্ত মান্নত৷ 
উদাহরণস্বরুপ কোরআনের একটি আয়াত থেকে বলছি: 

"যখন ইমরানের স্ত্রী (মরিয়মের মা) বলেছিলেন- হে আমার প্রতিপালক, আমার গর্ভে যা আছে তা একান্তভাবে তোমারই জন্য উত্‍সর্গ করলাম" 
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩৫) 

এখানে একজন মায়ের এইরুপ মান্নত সম্পূর্ণরুপে জায়েজ৷ 

কিন্তু পীরের নামে বা মাযারের নামে মান্নত করা হলে তা সম্পূর্ণরুপে হারাম৷ মান্নত করবার নামে পশুও জবাই করা হয়ে থাকে৷ আর এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কোরআনে উল্লেখ আছে, 

"তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জানোয়ার, রক্ত ও শুকরের মাংস এবং আল্লাহ ব্যতীত যা অন্যের উদ্দেশ্যে উত্‍সর্গ করা হয়৷" 
(সূরা মায়েদা, আয়াত: ৩) 

আর কবর বা মাযার যিয়ারত করবার প্রসঙ্গে এই হাদীসটি উল্লেখ করতে চাইছি, "যায়েদ বিন সাবেত (রা: ) রেওয়াত করেন, নবী করিম (সা: ) বলেছেন- কবর যিয়ারতকারী, কবরে মসজিদ নিমার্ণকারী ও সেখানে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনকারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ৷" 
(তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ ইবনে মাজা) 

অতএব, কোনভাবেই পীরবাদের ভিত্তিগুলোর সাথে ইসলামের মূল ভিত্তিগুলোর কোনদিক থেকেই সাদৃশ্য দেখছিনা৷ মূল বিষয়গুলো সব ক্ষেত্রেই ভিন্ন, বলতে গেলে পুরোপুরি বিপরীতমুখী৷ কাজেই আমি দ্বিধাহীনভাবেই স্বীকার করব, পীরবাদ সম্পূর্ণ ইসলামবর্জিত একটি ভিন্ন দর্শন ব্যতীত আর কিছুই নয়৷ উল্লেখ্য হুযুরপাক (সা: ) বলেছেন- "আল-ওলামাউ ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া" অর্থাত্‍ আলেমগণ নবী রাসূলের উত্তরাধিকারী৷ তাই আলেম হওয়াটাই সম্মানের ব্যাপার, পীর হওয়া নয়৷ 

(চলবে....)