আজ আমি গর্বিত এক মহান বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এর মেয়ে হিসাবে। স্বার্থক আমার জন্ম।
আর এই জন্মের স্বার্থকতা বজায় রাখার জন্য ইনশাল্লাহ চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আমার বাবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার কিছু স্মৃতি তুলে ধরতে চাই, তারই লেখনীর মাধ্যমে। আশা করি ব্লগারদের ভালো লাগবে।
লেখক : খ: জাহিদ মাহমুদ (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার)
আজ বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় উজ্জ্বল বিজয়ের দিন৷ বহু রক্ত, ত্যাগ, তিতীক্ষা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত এই বিজয়কে কোটি কোটি বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে এর আনন্দ ও সুফল পেঁৗছে দেওয়াটাই আজ আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ এ দিনটি প্রতিবছর আসে, আমাদের মাঝে জাতীয় স্মৃতি, ঐক্য, ঐতিহ্য ও দেশপ্রেমকে উদ্ভুদ্ধ করবার এক মহান অঙ্গীকার নিয়ে৷
মনে পড়ে আমার ৭১ এর সেই রক্তক্ষয়ী বিভিষিকাময় দিনগুলির কথা৷ আমি ছিলাম তখন “এডওয়ার্ড সরকারি মহাবিদ্যালয়” এর বাণিজ্যিক বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছাত্র৷ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সারা জাতি যখন দেশকে মুক্ত করবার বজ্র কঠিন শপথ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরল, তখন আমিও পাবনায় ৩১৩ জন শত্রু সেনা নিমূলের সাথে জড়িত থাকার গৌরব অর্জন করি৷ পরবর্তীতে পাবনা দখল হাত ছাড়া হবার পর বড় ভাইয়ের পরিবারসহ টাংগাইলের নাগরপুর থানার সারাংপুর গ্রামে পিতা ও পিতামহের সুনামধন্য “সাহেব বাড়ি” নামে খ্যাত বসত বাড়িতে আশ্রয় নেই৷ গ্রামে এসেই আমার বড় ভাইদের দেখাদেখি, আমিও আমার সহপাঠি বন্ধুদের নিয়ে দেশ মাতৃকার চরম মুহুর্তে সংগঠিত হবার কাজে যুক্ত হলাম৷ ঠিক সেই মুহুর্তে হিন্দুদের দোকান লুটের বিরুদ্ধে পারিবারিকভাবে রুখে দাঁড়ানো ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে এই তত্পরতার সংবাদ, নাগরপুর থানায় পেঁৗছে দিল স্থানীয় চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা৷ আর এই সংবাদ পেয়ে ছুটে এলো আমাদের বাড়িতে বর্বর পাকবাহিনী৷ অগি্নসংযোগ, লুটতরাজ এবং গুলি করে শহীদ করল আমার চার জন চাচা ও একজন চাচাতো ভাইকে৷ বড়ভাই লুত্ফর রহমান মিন্টুকে ধরে নিয়ে গেল নাগরপুর থানায় এবং থানার উত্তর পাশ্বর্ের ব্রীজে দাঁড় করিয়ে গুলি করল৷ কিন্তু, ভাগ্য ভাল, পানিতে লাফিয়ে পরে বেঁচে যান আমার ভাইটি৷ যিনি পরবর্তীতে বাতেন বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷
বন্দী হয়েছিলেন বড় ভাই লুত্ফর করিম, খ: ফজলুর রহমান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাইব্রেরীর প্রধান), আহাম্মাদুল হক, দুলাল, চাচা আবুল ফতে গোলাম সোবহান, আসাদুজ্জামান ও আমি নিজেও৷ মা ছিলেন উদর্ু ভাষায় পারদর্শী এবং বাড়িতে মসজিদ থাকায় কোরআন শরীফের দোহাই দিয়ে পরম করুনাময়ের অপার মহিমায় কোন রুপে প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন আমাদেরকে বর্বরদের হাত থেকে৷ গভীর রাতেই আমাদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হত্যাযজ্ঞ, অগি্নসংযোগ, তান্ডব ও লুটতরাজ করে বর্বর ক্যাপ্টেন তার দল নিয়ে ফিরে গেল৷ সেই রাতেই চাচাদের ও চাচাতো ভাইয়ের শহীদী রক্ত বুকে লাগিয়ে রক্ত শপথ করে গ্রাম ছাড়লাম৷ বহু কষ্ট ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যুক্ত হলাম বহেরাতৈলে কমান্ডার খ: মোছা চৌধুরীর কাদেরিয়া বাহিনীতে৷ তার পর চললো কঠিন প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তীতে উচ্চতর ট্রেনিং ও উন্নত হাতিয়ারের উদ্দেশ্যে ভারতে পেঁৗছালাম৷ সেখানে তুড়া ক্যাম্পে ২৮ দিন ট্রেনিং শেষে দেশ মাতৃকার সেবায় জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে শপথ নিয়ে দেশে ফিরলাম, বীর বিক্রম কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে৷ তারপর বিভিন্ন খন্ড যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পর এলো আমার জীবনের সেই স্মরণীয় মুহুর্ত৷ ঠিক রোজার ঈদের আগের দিন, সকাল থেকেই একত্র হলেন নিকটবর্তী সকল কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা, ফতেপুর ক্যাম্পে৷
তারপর কালিয়াকৈর হতে করটিয়া পর্যন্ত সকল ব্রীজে একত্রে একই সময়ে বীর প্রতিক হুমায়ুন বাঙ্গাল, আনোয়ার পাহাড়ী, হাসিবুল ও তানসের কে বলা হলো সোহাগপাড়া ব্রীজের পূর্ব পাশ্বর্ে জঙ্গলে অবস্থান নেয়ার জন্য৷ ভাতিজা কমান্ডার ফেরদৌসকে বলা হলো, তার লোক নিয়ে ব্রীজ থেকে পূর্ব পাশ্বর্ে ৪টি ডিনামাইট দিয়ে রাস্তা ফেলে দিতে, যাতে বর্বররা সহজে ব্রীজে আসতে না পারে৷
যুদ্ধ শুরু হলো৷ সময় যায়৷ আমি ও হুমায়ুন জঙ্গলে শুয়ে আছি৷ হঠাত্ দেখি একটি বাস ঢাকার দিক থেকে ব্রীজের দিকে যাচ্ছে৷ তা দেখেই হুমায়ুন উঠে পরে বাসে গুলি করলো, (শত্রুসেনাদের ব্রীজের অবস্থানের সাহায্যের জন্য যাচ্ছে ভেবে)৷ সময় যায়, ব্রীজ দখল হচ্ছে না দেখে হুমায়ুন অধৈর্য্য হয়ে বললো, “আমরা হেরে যাচ্ছি, আমাদের বেঁচে থেকে কি লাভ? চলো, আমরা এদিক থেকে আক্রমন করি৷” সত্যিই হুমায়ুন একজন দুঃসাহসিক যোদ্ধা ছিল৷ বলেই সে রাস্তার উত্তর পাশ্বর্ে চলে গেল, আমাকে বললো, দক্ষিণ পাশর্্ব দিয়ে ব্রীজের দিকে এগিয়ে যেতে৷ যথারীতি আমরা কালো অন্ধকারে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ব্রীজের ঠিক ৭০’-৮০’ ফুট দূরে উঁচু জায়গা দেখে পজিশন নিলাম৷ নিয়েই দুজন দুটি করে, চারটি গ্রেনেট ছুড়লাম, ঠিক ব্যাংকার লক্ষ্য করে এবং দুজনই একসাথে এস.এম.জি এর চারটি করে ম্যাগজিন শেষ করে ফেললাম৷ এই অপ্রত্যাশিত দুর্ধর্ষ আক্রমনে ব্রীজ ছেড়ে পালালো বর্বর বাহিনী৷ ব্রীজে উঠে চিত্কার দিয়ে দুজন একসাথে “জয় বাংলা” বলে চললাম৷ হঠাত্ মনে হলো, আমার এস.এম.জি খালি, গ্রেনেডও নেই৷ হুমায়ুনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, গুলি আছে নাকি৷ জানালো, একটাও নেই! আতংকিত হয়ে, আরো জোরে “জয় বাংলা” বলতে লাগলাম৷ ব্রীজ দখল হয়ে গিয়েছে দেখে, আমাদের ব্রীজে পশ্চিম পাশ্বর্ে যুদ্ধরত কমান্ডার সবুর খান ও অন্যান্যরা এসে তাড়াতাড়ি ব্রীজে ডিনামাইট সেট করে ব্রীজ উড়িয়ে দিল৷ রাত তখন প্রায় ১২ টার কাছে৷ আমরা মির্জাপুরের দিকে এগিয়ে চললাম৷ সবুর ভাই হলেন আমাদের সাথী৷ আজও মনে সেই গুলি ও গ্রেনেডবিহীন অবস্থায় শুধু মনের জোরের উপর ব্রীজ বিজয়কে “জয় বাংলা” বলে নিশ্চিত করেছিলাম৷ সেই উচ্চারিত “জয় বাংলা” ধ্বনি আজ কেউ কি দিতে পারবে? মনে পড়ে বাঙ্গালী জাতির গৌরব, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরলেন, আমরা কাদেরিয়া বাহিনী ধানমন্ডির ৩২নং এ গিয়ে সেই পবিত্র মুখের সাক্ষাত করলাম৷ ঠিক তখন নেতাকে গার্ড অফ অনার দেওয়াতে আমার বুকে নেতা তাঁর পবিত্র হাতে স্পর্শ করে মিষ্টি হাসি হেসে বলেছিলেন, “জয় বাংলা”৷ সেই বিজয়ের ও আনন্দের ঐতিহাসিক “জয় বাংলা” ধ্বনি আর কি কারও কোন দিন বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে শোনার ভাগ্য হবে?
আজ ৭১ এর সেই বিজয়ের দিনে মনে পড়ে, ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর, কান্না করে বলেছিলাম “হায়, দেশ ও জাতির জন্য কিছুই করতে পারলামনা”৷ যদিও বালিয়াতে সম্মুখ যুদ্ধে বর্বর পাকসেনা ৬জনকে নিমূল করে এবং ৪জনকে জীবিত আটক করি৷ এবং আটককৃতদের থেকে কমান্ডার বেনজীর (ক্যাপ্টেন হালিম গ্রুপের) ২ জনকে চেয়ে নেয়৷ মির্জাপুরে সম্মুখ যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনাসহ, শতাধিক রাজাকার আটক করি৷ যুদ্ধ শেষে দখল করা ৩ ট্রাক অস্ত্র ও ৫ জন জীবিত বর্বর পাকসেনাকে টাংগাইল থানায় সোর্পদ করি৷ আমার ভাই, চাচা, পরম আত্মীয়, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে৷ এক অনাবিল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ হিসাবে৷ সোনার বাংলায়, সোনার ছেলে ও মানুষ হওয়ার আহবান জানাই আজ এই বিজয়ের দিনে৷
স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির ঐক্য আজ বড়ই প্রয়োজন৷ কেননা, বর্বরদের দোসররা বড়ই তত্পর ও সংগঠিত৷ তাই এই বিজয়কে, স্বাধীনতাকে, সার্বিকভাবে স্বার্থক করতে, দেশ ও জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তিপ্রদান ও মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করবার জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন৷ তাই জাতীয় ঐক্য খুবই প্রয়োজন হয়ে পরেছে৷
দেশে প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেয়াটাই হোক্ আজ সবার অঙ্গীকার৷
আর এই জন্মের স্বার্থকতা বজায় রাখার জন্য ইনশাল্লাহ চেষ্টা চালিয়ে যাব।
আমার বাবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার কিছু স্মৃতি তুলে ধরতে চাই, তারই লেখনীর মাধ্যমে। আশা করি ব্লগারদের ভালো লাগবে।
লেখক : খ: জাহিদ মাহমুদ (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার)
আজ বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় উজ্জ্বল বিজয়ের দিন৷ বহু রক্ত, ত্যাগ, তিতীক্ষা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত এই বিজয়কে কোটি কোটি বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে এর আনন্দ ও সুফল পেঁৗছে দেওয়াটাই আজ আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ এ দিনটি প্রতিবছর আসে, আমাদের মাঝে জাতীয় স্মৃতি, ঐক্য, ঐতিহ্য ও দেশপ্রেমকে উদ্ভুদ্ধ করবার এক মহান অঙ্গীকার নিয়ে৷
মনে পড়ে আমার ৭১ এর সেই রক্তক্ষয়ী বিভিষিকাময় দিনগুলির কথা৷ আমি ছিলাম তখন “এডওয়ার্ড সরকারি মহাবিদ্যালয়” এর বাণিজ্যিক বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছাত্র৷ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে সারা জাতি যখন দেশকে মুক্ত করবার বজ্র কঠিন শপথ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরল, তখন আমিও পাবনায় ৩১৩ জন শত্রু সেনা নিমূলের সাথে জড়িত থাকার গৌরব অর্জন করি৷ পরবর্তীতে পাবনা দখল হাত ছাড়া হবার পর বড় ভাইয়ের পরিবারসহ টাংগাইলের নাগরপুর থানার সারাংপুর গ্রামে পিতা ও পিতামহের সুনামধন্য “সাহেব বাড়ি” নামে খ্যাত বসত বাড়িতে আশ্রয় নেই৷ গ্রামে এসেই আমার বড় ভাইদের দেখাদেখি, আমিও আমার সহপাঠি বন্ধুদের নিয়ে দেশ মাতৃকার চরম মুহুর্তে সংগঠিত হবার কাজে যুক্ত হলাম৷ ঠিক সেই মুহুর্তে হিন্দুদের দোকান লুটের বিরুদ্ধে পারিবারিকভাবে রুখে দাঁড়ানো ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে এই তত্পরতার সংবাদ, নাগরপুর থানায় পেঁৗছে দিল স্থানীয় চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা৷ আর এই সংবাদ পেয়ে ছুটে এলো আমাদের বাড়িতে বর্বর পাকবাহিনী৷ অগি্নসংযোগ, লুটতরাজ এবং গুলি করে শহীদ করল আমার চার জন চাচা ও একজন চাচাতো ভাইকে৷ বড়ভাই লুত্ফর রহমান মিন্টুকে ধরে নিয়ে গেল নাগরপুর থানায় এবং থানার উত্তর পাশ্বর্ের ব্রীজে দাঁড় করিয়ে গুলি করল৷ কিন্তু, ভাগ্য ভাল, পানিতে লাফিয়ে পরে বেঁচে যান আমার ভাইটি৷ যিনি পরবর্তীতে বাতেন বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন৷
বন্দী হয়েছিলেন বড় ভাই লুত্ফর করিম, খ: ফজলুর রহমান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক লাইব্রেরীর প্রধান), আহাম্মাদুল হক, দুলাল, চাচা আবুল ফতে গোলাম সোবহান, আসাদুজ্জামান ও আমি নিজেও৷ মা ছিলেন উদর্ু ভাষায় পারদর্শী এবং বাড়িতে মসজিদ থাকায় কোরআন শরীফের দোহাই দিয়ে পরম করুনাময়ের অপার মহিমায় কোন রুপে প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন আমাদেরকে বর্বরদের হাত থেকে৷ গভীর রাতেই আমাদেরকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হত্যাযজ্ঞ, অগি্নসংযোগ, তান্ডব ও লুটতরাজ করে বর্বর ক্যাপ্টেন তার দল নিয়ে ফিরে গেল৷ সেই রাতেই চাচাদের ও চাচাতো ভাইয়ের শহীদী রক্ত বুকে লাগিয়ে রক্ত শপথ করে গ্রাম ছাড়লাম৷ বহু কষ্ট ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যুক্ত হলাম বহেরাতৈলে কমান্ডার খ: মোছা চৌধুরীর কাদেরিয়া বাহিনীতে৷ তার পর চললো কঠিন প্রশিক্ষণ এবং পরবর্তীতে উচ্চতর ট্রেনিং ও উন্নত হাতিয়ারের উদ্দেশ্যে ভারতে পেঁৗছালাম৷ সেখানে তুড়া ক্যাম্পে ২৮ দিন ট্রেনিং শেষে দেশ মাতৃকার সেবায় জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে শপথ নিয়ে দেশে ফিরলাম, বীর বিক্রম কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে৷ তারপর বিভিন্ন খন্ড যুদ্ধে অংশ গ্রহণের পর এলো আমার জীবনের সেই স্মরণীয় মুহুর্ত৷ ঠিক রোজার ঈদের আগের দিন, সকাল থেকেই একত্র হলেন নিকটবর্তী সকল কোম্পানীর মুক্তিযোদ্ধারা, ফতেপুর ক্যাম্পে৷
তারপর কালিয়াকৈর হতে করটিয়া পর্যন্ত সকল ব্রীজে একত্রে একই সময়ে বীর প্রতিক হুমায়ুন বাঙ্গাল, আনোয়ার পাহাড়ী, হাসিবুল ও তানসের কে বলা হলো সোহাগপাড়া ব্রীজের পূর্ব পাশ্বর্ে জঙ্গলে অবস্থান নেয়ার জন্য৷ ভাতিজা কমান্ডার ফেরদৌসকে বলা হলো, তার লোক নিয়ে ব্রীজ থেকে পূর্ব পাশ্বর্ে ৪টি ডিনামাইট দিয়ে রাস্তা ফেলে দিতে, যাতে বর্বররা সহজে ব্রীজে আসতে না পারে৷
যুদ্ধ শুরু হলো৷ সময় যায়৷ আমি ও হুমায়ুন জঙ্গলে শুয়ে আছি৷ হঠাত্ দেখি একটি বাস ঢাকার দিক থেকে ব্রীজের দিকে যাচ্ছে৷ তা দেখেই হুমায়ুন উঠে পরে বাসে গুলি করলো, (শত্রুসেনাদের ব্রীজের অবস্থানের সাহায্যের জন্য যাচ্ছে ভেবে)৷ সময় যায়, ব্রীজ দখল হচ্ছে না দেখে হুমায়ুন অধৈর্য্য হয়ে বললো, “আমরা হেরে যাচ্ছি, আমাদের বেঁচে থেকে কি লাভ? চলো, আমরা এদিক থেকে আক্রমন করি৷” সত্যিই হুমায়ুন একজন দুঃসাহসিক যোদ্ধা ছিল৷ বলেই সে রাস্তার উত্তর পাশ্বর্ে চলে গেল, আমাকে বললো, দক্ষিণ পাশর্্ব দিয়ে ব্রীজের দিকে এগিয়ে যেতে৷ যথারীতি আমরা কালো অন্ধকারে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ব্রীজের ঠিক ৭০’-৮০’ ফুট দূরে উঁচু জায়গা দেখে পজিশন নিলাম৷ নিয়েই দুজন দুটি করে, চারটি গ্রেনেট ছুড়লাম, ঠিক ব্যাংকার লক্ষ্য করে এবং দুজনই একসাথে এস.এম.জি এর চারটি করে ম্যাগজিন শেষ করে ফেললাম৷ এই অপ্রত্যাশিত দুর্ধর্ষ আক্রমনে ব্রীজ ছেড়ে পালালো বর্বর বাহিনী৷ ব্রীজে উঠে চিত্কার দিয়ে দুজন একসাথে “জয় বাংলা” বলে চললাম৷ হঠাত্ মনে হলো, আমার এস.এম.জি খালি, গ্রেনেডও নেই৷ হুমায়ুনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, গুলি আছে নাকি৷ জানালো, একটাও নেই! আতংকিত হয়ে, আরো জোরে “জয় বাংলা” বলতে লাগলাম৷ ব্রীজ দখল হয়ে গিয়েছে দেখে, আমাদের ব্রীজে পশ্চিম পাশ্বর্ে যুদ্ধরত কমান্ডার সবুর খান ও অন্যান্যরা এসে তাড়াতাড়ি ব্রীজে ডিনামাইট সেট করে ব্রীজ উড়িয়ে দিল৷ রাত তখন প্রায় ১২ টার কাছে৷ আমরা মির্জাপুরের দিকে এগিয়ে চললাম৷ সবুর ভাই হলেন আমাদের সাথী৷ আজও মনে সেই গুলি ও গ্রেনেডবিহীন অবস্থায় শুধু মনের জোরের উপর ব্রীজ বিজয়কে “জয় বাংলা” বলে নিশ্চিত করেছিলাম৷ সেই উচ্চারিত “জয় বাংলা” ধ্বনি আজ কেউ কি দিতে পারবে? মনে পড়ে বাঙ্গালী জাতির গৌরব, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরলেন, আমরা কাদেরিয়া বাহিনী ধানমন্ডির ৩২নং এ গিয়ে সেই পবিত্র মুখের সাক্ষাত করলাম৷ ঠিক তখন নেতাকে গার্ড অফ অনার দেওয়াতে আমার বুকে নেতা তাঁর পবিত্র হাতে স্পর্শ করে মিষ্টি হাসি হেসে বলেছিলেন, “জয় বাংলা”৷ সেই বিজয়ের ও আনন্দের ঐতিহাসিক “জয় বাংলা” ধ্বনি আর কি কারও কোন দিন বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে শোনার ভাগ্য হবে?
আজ ৭১ এর সেই বিজয়ের দিনে মনে পড়ে, ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর, কান্না করে বলেছিলাম “হায়, দেশ ও জাতির জন্য কিছুই করতে পারলামনা”৷ যদিও বালিয়াতে সম্মুখ যুদ্ধে বর্বর পাকসেনা ৬জনকে নিমূল করে এবং ৪জনকে জীবিত আটক করি৷ এবং আটককৃতদের থেকে কমান্ডার বেনজীর (ক্যাপ্টেন হালিম গ্রুপের) ২ জনকে চেয়ে নেয়৷ মির্জাপুরে সম্মুখ যুদ্ধে ৩ জন পাকসেনাসহ, শতাধিক রাজাকার আটক করি৷ যুদ্ধ শেষে দখল করা ৩ ট্রাক অস্ত্র ও ৫ জন জীবিত বর্বর পাকসেনাকে টাংগাইল থানায় সোর্পদ করি৷ আমার ভাই, চাচা, পরম আত্মীয়, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তে মা বোনদের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে৷ এক অনাবিল সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ হিসাবে৷ সোনার বাংলায়, সোনার ছেলে ও মানুষ হওয়ার আহবান জানাই আজ এই বিজয়ের দিনে৷
স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তির ঐক্য আজ বড়ই প্রয়োজন৷ কেননা, বর্বরদের দোসররা বড়ই তত্পর ও সংগঠিত৷ তাই এই বিজয়কে, স্বাধীনতাকে, সার্বিকভাবে স্বার্থক করতে, দেশ ও জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তিপ্রদান ও মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে বিশ্বদরবারে পরিচিত করবার জন্য চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন৷ তাই জাতীয় ঐক্য খুবই প্রয়োজন হয়ে পরেছে৷
দেশে প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেয়াটাই হোক্ আজ সবার অঙ্গীকার৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন