আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাপ, ভাই-বোন। ভাতের লড়াইয়ে তারা হেরে গেল।
এই হচ্ছে শুরু......"সূর্য-দীঘল বাড়ী" এর।
আবু ইসহাকের এ এক স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাস হিসাবে সমাদৃত। অুনদিত হয়ে বইটি বিভিন্ন বিদেশী ভাষাতেও প্রকাশিত হয়েছে। আবু বাশার মোহাম্মদ ইসহাক (আবু ইসহাক, ১৯২৬-২০০৩) এর জন্ম শরীয়তপুর জেলায়। সাহিত্যের সংখ্যা হয়ত বেশী নয় তবে যাই সৃষ্টি করেছেন তা এক একটি জেমস্ বললে ভুল হবে না।
আফসোস হচ্ছে কেমন করে যেন এই সাহিত্যটা পড়া হয়নি আগে। বঞ্চিত মনে হচ্ছিল নিজেকে। যাগ্ গে এ নিয়ে তো রিভিউ দেবার ক্ষমতা আমার মোটেও নেই । শুধুমাত্র নিজের অনুভুতিগুলোকে নিয়েই নাড়াচাড়া। সাধারণের সাহিত্যানুশীলন...এই আর কি।
এক মুঠো ভাতের জন্যে বড়লোকের বন্ধ দরজার ওপর মাথা ঠুকে ঠুকে পড়ে নেতিয়ে। রাস্তার কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়। দৌলতদারের দৌলতখানার জাঁকজমক, সৌখিন পথচারীর পোশাকের চমক ও তার চলার ঠমক দেখতে দেখতে কেউ চোখ বোজে। ঐশ্বর্যারোহীর গাড়ীর চাকায় নিষ্পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় কেউ বা।..............................তাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ধনুকের মত বাঁকা দেহ- শুষ্ক ও বিবর্ণ।
পঞ্চাশের মন্বন্তর এমনই ভাবে ফুটে উঠে। সহজ অথচ কত বৃত্তান্ত।
কাহিনী জয়গুনের...তার মেয়ে মায়মুন, ছেলে হাসুর। আর শফির মায়ের। আরো কাসুর, করিম বকশ, গদু প্রধান এর। আর 'সূর্য-দীঘল বাড়ী' !! এ হচ্ছে এর নিজের ইতিহাসেই এক কলংক, অভিশাপ। পূর্ব-পশ্চিম প্রসারী বাড়ী তাই সূর্য-দীঘল বাড়ী।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কুসংস্কারগুলো আপনাতে্ই কখন যেন মাথা থেকে পায়ের নিচে চলে আসে। ক্ষুধার কষ্ট বড় করুন। লেখক বলেছেন..
"রমজান মাসের রোজার চেয়েও যে ভয়ঙ্কর এ রোজা। রমজানের একমাস দিনের বেলা শুধু উপোস। কিন্তু তার বারোমেসে রোজার যে অন্ত নেই।"
অসহায় অবস্থায় অন্যের দারস্থ না হয়ে খেটে খাইতে গেলেও..সংগ্রাম করতে গেলেও অন্ধ সমাজের চোখ রাঙ্গানো এড়ানো বড় কঠিন। অন্ধ সমাজের সব কিছুর ব্যাখ্যা, সংগাও অন্ধ। সেখানকার ডিকশেনারিতে "মানবতা" শব্দটির নেই কোন অস্তিত্ব।
অথচ অনুভূতিগুলো কতটা গভীর। কিভাবে? মানুষ সত্যিই বিচিত্র। জয়গুনকে "তোবা" করতে হবে। না হয় মেয়ের বিয়ে আর দেয়া হবেনা। শুধু সে সময়টার জন্যে "তোবা" অথচ নাহ্...জয়গুনের বিবেক তাকে শিখিয়েছে "তোবা" একবার করলে তা সে ভাঙতে পারবেনা্। এই মানসিকতাকে কোন আঙ্গিকে বিচার করা যায়? আর সেই "তোবা"ই ভেঙে ঘরের বাইড়ে যেতে হয় যখন আরেক নারী তাকে সেই একই ধর্মের বাণী শোনায়..
"না খাইয়া জানেরে কষ্ট দিলে খোদা ব্যাজার অয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পাও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া ট্যাকা রুজি করনের লেইগ্যা। .....
"আত আছিল, পাও আছিল
আছিল গায়ের জোর।
আবাগী মরল ওরে
বন্দ কইরা দোর।"
আমার একটা প্রিয় কবিতা রবিঠাকুরের লেখা। যেখানে তিনি শরৎবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন একটা সাধারণ মেয়ের গল্প লেখার জন্যে। জয়গুন কি সেই সাধারণ মেয়ে নাকি সংগ্রামী কোন নারী? গোর্কি এর মায়ের ছোঁয়া এতে? যে জানে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়!! জয়গুন কে রোল মডেল বানাতে কোনও অসুবিধা নেই।
"মেয়ে বলে মায়মুনকে এতদিন সে অনাদর করেই আসছে। কিন্তু অার না। হাসু কোলের আর মায়মুন পিঠের- তা তো নয়! দু'জনকেই সে পেটে ধরেছে।...."মায়মুনের জন্যে আর কোন দিন জয়গুন এমন করে ভাবেনি। আজ হাসু ও মায়মুন তার চোখে সমান হয়ে গেছে।"
কাসু যখন অসুস্থ জয়গুন ছুটে আসে তার পূর্বের স্বামীর ঘরে ফেলে আসা ছোট এই ছেলেটির টানে।....
"তোমরা ডাকতর দেহাইছিলা?
- ডাকতর কি করব? কত ফকির হট্ খাইয়া গেল!
অন্ধকারের মধ্যে জয়গুন আলো খুঁজে বেড়ায়। নিরাশার মধ্যেও আশা চেপে ধরে বুকে। ঝড়-ঝঞঝার মধ্যেও সে হাল ছেড়ে দেয় না।"
লেখক এক জায়গায় খুব চমৎকার কথা বলেছেন। বাস্তবতার আঙিনায় এ অনেক সত্যকথন।
"নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। 'যেমন কর্ম তেমন ফল' তাই সব সময়ে পাওয়া যায় না। মাথার ঘাম পায়ে-ফেলা সারাদিনের কর্মফল বড় সামান্য। পরোপকার প্রায়ই বিফলে যায়। সে কর্মে যদিও ফল ফলে, তা তিতো, বিষাক্ত। এটা অনিয়ম বৈকি।"
সম্পর্কের টান-পোড়ন ছিল জয়গুন আর করিম বকশ এর। কাসুর জন্যে জয়গুনের হাহাকার আর কাসুর মায়ের কাছে যাবার আকুতি। আছে হাসুর অবিরত খাটুনি, মায়মুনের নিষ্পাপ শৈশব, রুগ্ন সমাজের পৈশাচিকতা আরও কত কি! শুধু বলব, আমার মতো যারা এতদিন বঞ্চিত ছিলেন... বইটাকে এখনই হাতে নিয়ে নিন।
লেখক শেষ করেছেন "সূর্য-দীঘল বাড়ী" এর ভুত ক্ষেপানো মধ্য দিয়ে। আর জয়গুনদের খোদার বিশাল দুনিয়ায় মাথা গুঁজবার একটু ঠাঁইয়ের খোঁজে।
"চলতে চলতে আবার জয়গুন পেছনে ফিরে তাকায়। সূর্য-দীঘল বাড়ী! মানুষ বাস করতে পারে না এ বাড়িতে। দু'খানা ঝুপড়ি। রোদ বৃষ্টি ও অন্ধকারে মাথা গুঁজবার নীড়। দিনের শেষে কাজের শেষে মানুষ পশু-পক্ষী এই নীড়ে ফিরবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। ঐ উঁচু তালগাছ অনেক কালের অনেক ঘটনার নীরব স্বাক্ষী এটা।
তারা এগিয়ে চলে।
বহুদূর হেঁটে শ্রান্ত পা-গুলোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তারা গাছতলায় বসে। উঁচু তালগাছটা এত দূর থেকেও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আবার তারা এগিয়ে চলে.........।"
বাংলা একাডেমী পুরস্কার : ১৯৬২-৬৩
সুন্দরবন সাহিত্য পদক : ১৯৮১
একুশে পদক : ১৯৯৭
স্বাধীনতা পদক মরনোত্তর : ২০০৪
এ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র "সূর্য-দীঘল বাড়ী" ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
* ১৯৮০ সালে পশ্চিম জার্মানীতে অনুষ্ঠিত ২৯তম ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে "ডুকার্ট" (স্বর্ণপদক)।
* ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে 'মানবিক আবেদনের' জন্যে আন্তর্জাতিক ইভানজ্যালিক্যাল (প্রোটেস্ট্যান্ট) সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংস্থার দুটি বিশেষ পুরস্কার।
* পুর্তগালে অনুষ্ঠিত ১৯৮০ সালের 'নবম ফিগুয়েরা দ্য ফজ' আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উ্ৎসবে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ-এর 'প্রিকস ডন কুইকজোট' পুরস্কার।
* ২২তম ১৯৮০ কার্লোভিভেরী (চেকোশ্লোভাকিয়া) চলচ্চিত্র উৎসবে ডিপ্লোমা লাভ।
* নেদারল্যান্ডের ইন্টার চার্চ ফিল্ম সেন্টার এর বিশেষ পুরস্কার 'ইন্টার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড' ১৯৮০।
* বাংলাদেশের ১৯৭৮ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে 'জাতীয় পুরস্কার' ও বিভিন্ন বিভাগে আরো 'আটটি' পুরস্কার।
* ১৯৭৯ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির' পুরস্কার ও বিভিন্ন আরো 'পাঁচটি' পুরস্কার।